ভারতে চিকিৎসা,খ্রিস্টান মেডিকেল কলেজ (সি এম সি) ভেলুর
															আচ্ছা কেমন হতো যদি কোন মানুষ অসুস্থ না হতো। একবার মনে হয় ভালো হতো আরেকবার মনে হয় না—সুস্থ থাকা কত বড় নিয়ামত তা বুঝার জন্য হলেও ছোটখাটো অসুখ হওয়া উচিত। কিন্তু হায়, আমাদের নিজেদের অসাবধানতার জন্য বড় বড় রোগ বাঁধিয়ে বসে থাকি। তারপর এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল দৌড়াই। দেশে-বিদেশে কত শত ডাক্তার-কবিরাজ।
আমিও এই দলের লোক। দেশে দৌড় শেষ করে এখন বিদেশে এসেছি চিকিৎসা নিতে। বাঙালীদের জন্য প্রতিবেশী দেশের সবচেয়ে ভালো হাসপাতালগুলোর একটিতে—খ্রিস্টান মেডিকেল কলেজ (সি এম সি) ভেলুর, চেন্নায়। দেশে বা বিদেশি যে কোন হাসপাতালে প্রথমবার গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়, আবার যদি সেটা বিদেশের মাটিতে হয়, তার উপর আপনি সে দেশের ভাষা জানেন না তাহলে তো ভোগান্তির শেষ নাই।

ভেলুর হলো তামিলনাড়ু এর রাজধানী চেন্নাইয়ের একটি শহর। ভারতে বাংলাদেশীরা যে কয়টা হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়, তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আসে সি এম সি তে। আজকে সি এম সি তে চিকিৎসা নেয়ার পুরো প্রক্রিয়া লিখবো। আমি এখানে আসার পর যে পরিমাণ অভিজ্ঞতার অভাব বোধ করেছি সেগুলোই লিখবো।
প্রথমে আপনাকে ভারতীয় মেডিকেল ভিসার জন্য সি এম সি এর কর্তৃপক্ষ থেকে ইনভাইট পেতে হবে। iro@cmcvellore.ac.in এই ওয়েবসাইটে মেডিকেল ভিসার জন্য হাসপাতালের আমন্ত্রণ চিঠির জন্য আবেদনপত্র পাবেন। সেটা পূরণ করে সব তথ্য দিলে আপনি সেই চিঠি পাবেন। তারপর বাকি সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভিসা আবেদন কেন্দ্রে গিয়ে ভিসা আবেদন করতে পারেন। আমি মূলত ভিসা নিয়ে লিখছি না, হাসপাতালের কার্যক্রম নিয়ে লিখছি।

ভিসা পাবার পর আপনার প্রথম কাজ হবে চেন্নাই আপনি কিভাবে আসতে চান সেটা ঠিক করা। হাতে সময় নিয়ে টিকিট কাটতে পারলে এয়ার ভাড়া পরবে কম। চাইলে বিভিন্ন স্থলপোর্ট দিয়েও কলকাতা এসে তারপর ট্রেন বা বিমানে আসতে পারেন চেন্নাই। চেন্নাই এসে বাস বা ট্রেনে ভেলুর শহর কিংবা কাডপাটি রেলওয়ে জাংশনে আসতে পারেন, তারপর সি এম সি অটোতে। যদি এয়ারে আসেন তাহলে বিমানবন্দরের পাশেই মেট্রো স্টেশন—সেখান থেকে মেট্রো করে বাস টার্মিনালে আসলে সি এমবিটি বাস টার্মিনালের টিকিট করবেন। আর যদি ট্রেনে যাত্রা করতে চান তাহলে চেন্নাই সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের টিকিট করবেন। আর ট্রেনে চেন্নাই আসলে সেখান থেকেই কাডপাটি কিংবা বাস টার্মিনাল থেকে ভেলুর আসবেন।

সি এম সি তে আসার আগে দুইটা কাজ অবশ্যই করে নিবেন—
প্রথমত কোথায় থাকবেন তা চিন্তা করে আসুন। সি এম সি এর আশেপাশে অনেক হোটেল আছে, যে কোন হোটেলে থাকতে পারেন। তবে আগে থেকে বুকিং দেয়া যায় না তেমন, এসে দিতে হয়। আবার কিছু গুলোতে দেয়া যায়। আপনি বুকিং দেন আর নাই দেন, হোটেল ঠিক করে আসুন। না হলে এতো জার্নি করে সি এম সি তে পৌঁছে ঘুরে ঘুরে হোটেল ঠিক করা কঠিন। সায়দাপেট, গান্ধী রোডে প্রচুর হোটেল, প্রচুর বাঙালি খাবার ও থাকার ব্যবস্থা পাবেন।
সবচেয়ে ভালো হয় প্রথম দুই-এক দিন একটা হোটেলে থেকে তারপর কতদিনের ট্রিটমেন্ট চলবে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেল পরিবর্তন করুন। অনেক হোটেল আছে মাসের জন্য ভাড়া দেয়, নিজে রান্না করে খাওয়া যায়। আমি সি এম সি এর কাছেই মেইন রোডের উপর “জয় ভারত লজে” উঠেছিলাম। এটার মালিক খুবই হেল্পফুল। একটু বেশি ভাড়া, তবে সব সুবিধা পাবেন। নিচে ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।
দ্বিতীয় হলো—ডাঃ অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে আসা। নির্দিষ্ট রোগের জন্য ডাঃ সিরিয়াল দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে আসুন। এটা ছাড়া ইমিগ্রেশনে ঢুকতে পারবেন না।

এবার আসি চিকিৎসায়
যেহেতু আপনি অন্য দেশ থেকে এসেছেন তাই কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।
আপনি হোটেলে উঠতেই হোটেল কর্তৃপক্ষ আপনাকে একটা ফর্ম পূরণ করতে দেবে যেটা পরে কাজে লাগবে। সেটা হলো সি ফর্ম। চাইলে নিজে করতে পারেন জানা থাকলে, না হলে ১৫০ রুপির বিনিময়ে হোটেল কর্তৃপক্ষ করে দেবে।
সি এম সি তে আপনার প্রথম দিনঃ
সকাল ৭টার দিকে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, মেইন পাসপোর্ট ও সকল ডকুমেন্টস নিয়ে সোজা চলে আসবেন। মেইন গেট থেকে একটু দূরেই 900 B বিল্ডিং আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। সাথে অবশ্যই যদি অ্যাটেন্ডেন্ট থাকে তবে তার সকল ডকুমেন্টসহ নিয়ে যাবেন। হাসপাতালে আপনার প্রথম কাজই হবে 900 B তে যাওয়া। যে যত কথাই বলুক আপনি প্রথমে সেখানে যাবেন।


ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে টোকেন নিয়ে প্রথম তলায় গিয়ে ৬০০ রুপি দিয়ে একটা হেলথ কার্ড করে নিবেন যেটা দিয়ে আপনার সব কার্যক্রম চলবে। সাথে সি ফর্মের জন্য একটা ফরম দিবে সেটা পূরন করে হোটেল কতৃপক্ষ কে দেন সি ফর্মের সময় কাজে লাগবে। হাসপাতারে ভর্তি হতে হলে বা অপারেশন করলে সি ফর্ম লাগবে।
৮.৩০ এর পূর্বেই এখানের কাজ শেষ করে মেইন গেটের পাশে ওপিডি ভবন ও আরো কিছু ভবন আছে। আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টে ডাক্তার নামসহ ভবন ও রুম নাম্বার দেয়া থাকবে ও সময়। সেখানে গিয়ে রিপোর্ট করলে প্রথমে আপনার ওজন ও হাইট মেপে নির্দিষ্ট ডাঃ এর রুমের সামনে পাঠাবে।
ডাঃ আসলে একে একে ডাঃ নিজেই মাইকে নাম ডেকে রুমে নিবেন। কোন ধরনের তাড়াহুড়ো বা বারবার গিয়ে সিরিয়াল নেয়ার দরকার নেই। খুবই শৃঙ্খলভাবে এখানে সব কাজ হয়। প্রয়োজনে সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করবেন। ডাঃ যদি বাংলা পারেন তবে তো হলোই, কিংবা আপনি ইংরেজি বা হিন্দি জানলে সমস্যা নেই। আর না হলে দোভাষী সেবা পাবেন, ডাঃ কে বললেই।
ডাঃ কে মন খুলে সব বলবেন। সব শুনে যদি টেস্ট দেয় তো দিলোই, না হলে ওষুধ দেবে। যদিও সাধারণত এটা হয় না—প্রথমে টেস্ট দেয়, তারপর রিপিট ডেট দিয়ে টেস্ট রিপোর্টসহ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়।

ডাঃ রুম থেকে বের হয়ে প্রতিটি ফ্লোরে বিলিং কাউন্টার আছে। যেখানে ফাঁকা পাবেন সেখানে টাকা জমা দিন। প্রথম দিন সাথে ক্যাশ নিয়ে যাবেন মিনিমাম ৮ থেকে ১০ হাজার। বা যদি কার্ডে পেমেন্ট করতে চান তবে অবশ্যই সে কার্ড যেন একটিভ থাকে। ডুয়েল কারেন্সি ভিসা কার্ড সি এম সি তে সাপোর্ট করে। টাকা জমা দিলে রিসিটে টেস্টের জন্য কোন রুমে যেতে হবে তা বলে দেবে। সেখানে গিয়ে স্যাম্পল দিয়ে টেস্ট করে রুমে ফিরে যান এবং অপেক্ষা করুন রিপিট ডেটের জন্য।
অনেক সময় সি এম সি এর আরেকটি ক্যাম্পাস আছে ভেলুর শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে রানিপেটে। সেখানে যেতে হতে পারে। তখন সি এম সি এর সিলভার গেটের সামনে থেকে রানিপেটের বাস যায়—সি এম সি এর নিজস্ব সেটা দিয়ে ফ্রি যেতে পারেন।
সব টেস্ট শেষ হয়ে গেলে রিপিট ডেটের জন্য বা যদি অন্য কোন ডাঃ রেফার করে সেটার ডেট ও যদি সময় লাগে তাহলে ভেলুর শহরের আশেপাশে কিছু জায়গা আছে দেখতে পারেন।
রিপিট ডেটের দিন আপনার রিসিটে যে সময় ও রুম নাম্বার দেয়া থাকবে তার মিনিমাম ১০-১৫ মিনিট পূর্বেই পৌঁছে যান। সেখান থেকে স্লিপ নিয়ে ডাঃ এর জন্য অপেক্ষা করুন।

ডাক্তার দেখে আপনাকে সিদ্ধান্ত দেবে। যদি অপারেশন লাগে কিংবা ভর্তি হতে হয় তখন তা সাজেস্ট করবে। আর ওষুধ দিলে টাকা জমা দিয়ে ফার্মেসিতে চলে যান—ওষুধ দিয়ে দেবে। আর রিপোর্ট লাগলে বলবে, লিখে দেবে ডাক্তার। কোন রুমে যেতে হবে বলে দেবে—সেখান থেকে নিয়ে নিবেন রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন। অবশ্য ততদিনে আপনি সব বুঝে যাবেন।
 
ভারতের বেশিরভাগ হাসপাতালেও এমনভাবেই চিকিৎসা হয়। ইংরেজি কিংবা হিন্দি জানা থাকলে সুবিধা হয়, বাংলাতেও পাবেন।
দিনশেষে ভালো থাকুন, সুস্থ থুকুন, সাবধানে থাকুন।
বিঃদ্রঃ ঘুরতে গিয়ে কোথাও ময়লা ফেলবেন না এবং স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
সেপ্টেম্বর ২০২৫
															