শহরের কুড়
															আমি একটা গল্প বলে খুব আরাম পাই তাই আবার বলি ‘একবার একটা প্রজেক্টের কাজে গাইবান্ধার এক চরে গিয়েছিলাম, বিশাল বড় চর,চরে ঠিকানা খোঁজার জন্য বুড়ো চাচা কে জিজ্ঞাস করলাম, উনি ঠিকানাটা ভালো করে বুঝিয়ে একটা ভ্যান ঠিক করে দিলেন ভ্যানে বসে চাচাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম আপনার এলকার মানুষজন খুব ভালো, উনি শুনে একটা রহস্যময় হাঁসি দিয়ে বললেন” বাবা আমরা সহজ সরল বোকা সোকা মানুষগুলো গ্রামে আছি আর টাউট বাটপার মানুষ ঠকানো মানুষরা শহরে চলে গেছে”
কথাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে গেলাম কত কঠিন কথা  কত সহজে বললেন উনি, ভ্যানে বসে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কথাটার সত্যতার গভীরতা ভেবে কোন তল পাই নি।
আমি সবসময় বিশ্বাস করি কথাটা ধ্রুব সত্য।
এ বছর ফাল্গুনের হাওর দেখতে পরমআত্মীয়র বাড়িতে  গিয়েছিলাম, রাতে সেখানেই থাকবো।
সারাদিন হাওরে ফাল্গুনের রৌদ্র মাথায় নিয়ে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে  বাড়িতে ফিরলাম। হাওরে শহরের মত হুট করে সন্ধ্যে নামে না, বলে কয়ে ডাক ঢোল পিঠিয়ে  সন্ধ্যা নামে, একদিকে সুর্যিমামা নামে অন্যদিকে
ফেলে যাওয়া নীড়ে ফিরে শামুক খোল পাখিরা।হাঁস মুরগি সারাদিন বাইরে টো টো করে তাদের খাঁচার সামনে চলে আসে,গরু নিয়ে ফিরে কিশোর , মাথায় ঘাসের বোঝা নিয়ে মাঠ থেকে ফিরে আসে কৃষক সন্ধ্যা নামাতে এতো আয়োজন আর কোথায় দেখি নি আমি।
গ্রামের নাম হৌলহৌরি বর্ষার সময় মাথা জাগিয়ে রাখা এক দ্বীপ। ২০-২৫ টা পরিবার থাকে বর্ষায় এরাও অালাদা নৌকা ছাড়া কোথায় যেতে পারে না।এখন পুরো কাজের সময় দ্রুত সবাই ধানের কাজ শেষ করছে,দ্রুত না শেষ করতে পারলে হুট করে চলে আসা পাহাড়ি ঢলে একরাতে সব কষ্ট অনর্থক।তাই সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় একটু সময় পায় হাওরের মানুষ।
মাগরিবের আজান দেয়ার পর পরই সবাই নামাজে আসে, নামাজ শেষ করে গ্রামের দোকানে বসে গল্পের আসর এই ২০-২৫ টা পরিবারের একমাত্র দোকান, ফসলি জমির কীটনাশক থেকে মানুষের ঔষধ, চা থেকে তেল যাবতীয় পন্য একই দোকানে।সবাই নামাজ শেষ করে এসে গল্পের আসর বসে।
হাওরের গোড়াপত্তন থেকে এই নিয়ম, অতীতে বসতো বাড়ির উঠোনে এখন বসে দোকানে।
কত বিচিত্র গল্প  ভূত প্রেত, হাওরের ঝড়, মাছ ধরতে যেয়ে মৎসকন্যার সাথে দেখা!
সময় বদলেছে  এই বদলানোর সাথে গল্পের ধরনও বদলে গেছে আজকাল বেশি যে গল্পের আসর বসে তা হলো এই স্বর্গপুরী থেকে হাওরের মানুষ বেরিয়ে যখন শহর নামক কুড়ে আসে সেখানে কুড়ে এসে বিপদে পরার গল্প।
কুড় বলতে নদীতে মাঝে মাঝে গভীর অগভীর কিছু খাদ থাকে নদীতে স্রোত থাকলে এইসব খাদে পাক নেয়, কৃষকরা ফসল নিয়ে যাবার সময় এইসব কুড় পার হবার জন্য ভেট হিসাবে ফসলের বস্তা দিত। মাঝে মাঝে নৌকা ডুবে গেলে নদীর নিচের জলরাজা ভেটে তুষ্ট না হয়ে তার বাহুতে নিয়ে নেয় এমন ভেবে আপসোস করে মানুষ। এই ধারনা হাওরের প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে, এই কুড় যেমন হাওরের নৌকাবাহি কৃষকদের কাছে ভয়াবহ বিপদ তেমনি শহর নামক কুড় ও হাওরের সহজ সরল মানুষদের জন্য বিপদের জায়গা।
দোকানে যেয়ে বসতেই এক কিশোর একটা পানথাল এগিয়ে দিলো হাসি মুখে, কি সৌন্দর্য করে গুছানো পানথাল কাঁসার থাল একপাশে পান তার পাশে সুপারি ছোট ছোট করে কাটা ঠিক মাঝখানে বাটিতে চুন আর সুগন্ধযুক্ত জর্দা , জর্দার গন্ধ খুবই জুইতের লোভ সামলাতে না পেরে একটা পান তৈরি করে খেয়ে নিলাম, চোখ লাল হয়ে গেছে পানে ধরছে।
ষাটোর্ধ্ব একজন আমার আনাড়ি হাতে তৈরি পান খাওয়ার দৃশ্য আয়েশ করে দেখছেন আর হাঁসছেন।
হাঁসতে হাঁসতে গল্প শুরু করলেন গল্পের ফাঁকে সবাই চা আর পানথাল থেকে পান নিয়ে খাচ্ছে।
পান খাওয়া নিয়ে গল্প শুরু হলো,  চাহাজি ( বয়স বেশি বলে সবাই সম্মান করে চাহাজি ডাকে, শহরে মানুষ যেমন আদর করে বাবু ডাকে হাওরে বাবু কে আবু ডাকে আবু মানে সদ্য জন্ম নেয়া মনুষ্যসন্তান )
একবার ছোট ছেলেকে ডাক্তার দেখাইতে ময়মনসিংহ গেছেন ডাক্তার আসতে দেরী দেখি চাহাজি পান আর বিড়ি খাইতে হাসপাতালের বাইরে আসছেন। অতো বড় শহর কত গলি হাসপাতালের কত রুম কত মানুষ ঠিক রুম চিনে যাওয়াটা খুবই দুরূহ উনার জন্য।তবু কষ্ট করে এসে একটা ভ্রাম্যমান পান দোকান থেকে একটা সিগারেট নিলেন, শহর বন্দরে বিড়ি পাওয়া যায় না সিগারেট উনি আয়েশ করে খেতে পারেন না, কাঁশি হয় তবু বহু বছরের অভ্যাস তাই সিগারেট, সিগারেট জ্বালিয়ে পান চেয়ে গল্প শুরু করলেন দোকানির সাথে দোকানি একবার হাওরে গেছে হাওরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হওয়ার গল্প বলতে বলতে দোকানি চাহাজি কে নতুন এক জর্দা দিয়ে পান দিলেন এই জর্দা একবার খাইলে নাকি সারাদিন মুখ থেকে সুগন্ধ বের হয় চাহাজিও কথা শুনে খেয়ে নিলেন, পান চিবাতে শুরু করার পর খুব আরাম বোধ করছেন আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো তারপর আর কিছু মনে নেই!
পর দিন সকালে নিজেকে আবিস্কার করলেন হাসপাতালের বারান্ধায় শুয়ে আছেন মাথার কাছে ছেলে বসে কান্না করছে।চোখ খুলে বুঝতে পেরেছেন যা হবার হয়ে গেছে,লুঙ্গী তে রাখা পুঁটলি নেই, পাঞ্জাবীর পকেটের কিছুই নেই। আপসোস আর হা হুতাশ করতে করতে বাড়ি আসলো ছেলের হাত ধরে।
গল্পটা এতো সহজ আর হাঁসিমুখে বললেন যে  কিছুই হয় নি ঐ মানুষটার কোন দোষই না।
মানুষ কতটা সহজ সরল হলে এইরকম গল্প সহজে হাঁসিমুখে বলে দিতে পারে কোন রকম দোষ কাউকে না দিয়ে! আহারে দুনিয়া কত ভালো মানুষ থাকে।
এই গল্প শেষ করতেই আরেকজন শুরু করলেন ।তিনি একবার ঢাকা গেছেন বিদেশ যাবে তাই কাগজপত্র ঠিক করতে হবে।সেই কাগজপত্র নিয়ে দালালের থেকে নেয়া ঠিকানা নিয়ে বাসে উঠলেন, বাস থেকে নেমে ঠিকানা জিজ্ঞাস করার জন্য লোক খুঁজতে যেয়ে এক  রিকসাওয়ালাকে দেখে ভালো লোক মনে হলো তাই জিজ্ঞাস করলেন  রিকসাওয়ালা হাত দিয়ে বাম ডান, ডান বাম দেখিয়ে বললেন যেতে আর যদি  রিকসা করে নেয় তাহলে ৮০ টাকা লাগবে, হারিয়ে যাবার ভয়ে রিকসায় উঠে ১০ মিনিট ঘুরার পর আবার সেই মোড় এনে নামিয়ে অফিস দেখিয়ে ৮০ টাকা নিয়ে নিলেন, নিজের বোকা হবার কথা বলে হাঁসতে হাঁসতে কাঁশি শুরু হয়ে গেলো উনার সাথে সবাই কাঁশি শুরু করলো।
রাত ৯ টা পর্যন্ত এমন হাঁসির গল্প শুনি, সবাই শহর নামক কুড়ে এসে কোন না কোন বিপদে পরে।
শহরের মানুষজনদের কাছ থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে হাওরে ফিরে আসে, এসে গল্প বলে ছেলে বুড়োদের সাথে,  হাঁসেন আর সাবধান করেন।
এদের কাছে শহর আর হাওরের কুড় একি রকম দুই জায়গাতেই বিপদ।
এতো বিপদের পরও শহরের মানুষদের জন্য উনাদের সম্মানের কমতি নেই শহরের কেউ আসলে তাকে ফেরশতার মত মেনে অতিথিয়তা করেন। শহরে গেলেও শহরের মানুষদের ফেরশতার মত বিশ্বাস করে বিপদে পরেন, তবু বিশ্বাস কমে না
তাদের কাছে শহরের মানুষদের ফেরশতা মানা অদিষ্ট।
গাইবান্ধার সেই চাচা আসলেই ঠিক আমরা শহরে শুধু মানুষ ঠকানো নিজেকে বড় ভাবা  অমানুষ থাকি।
শহরের এই অমানুষগুলো দ্রুত মানুষ হোক।
আবার আমরা মানুষ হই।
শুভ সন্ধ্যা
															