ভেলুর ফোর্ট: দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী
															দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে, ভেলুর শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা — ভেলুর ফোর্ট। প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে নির্মিত এই দুর্গ শুধু স্থাপত্যের নিদর্শনই নয়, বরং ভারতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ও বটে। ভেলুর ফোর্ট নির্মাণ করেন বনজার রাজা চিন্না বোম্মা নাইয়াকা, যিনি বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে শাসন করতেন। ১৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এই দুর্গটি সম্পূর্ণভাবে গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরি। তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্যে এটি ছিল অন্যতম শক্তিশালী দুর্গ।
 
 
দুর্গটির চারপাশে গভীর একটি খাল রয়েছে, যা একসময় কুমিরে ভরা থাকত। এই ব্যবস্থা শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য গড়া হয়েছিল — ফলে ভেলুর ফোর্টকে প্রায় অভেদ্য বলা হতো।ভেলুর ফোর্টের স্থাপত্যে দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের ঐতিহ্য, মুঘল প্রভাব এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের এক অনন্য সংমিশ্রণ।
ফোর্টের ভেতরে রয়েছে —
জালাগান্দেশ্বর মন্দির (Jalagandeeswarar Temple) — সূক্ষ্ম পাথরের কারুকার্য আর ভাস্কর্যে ভরপুর এক অপূর্ব মন্দির।
 
 
একটি প্রাচীন মসজিদ, যা মুঘল আমলে নির্মিত হয়। (মসজিদটি বর্তমানে বন্ধ আছে।)
 
 
একটি চার্চ, যা ব্রিটিশ শাসনের সময় গড়ে ওঠে।
 
 
এই তিনটি ধর্মীয় স্থাপনা একই প্রাচীরের মধ্যে থাকা তখনকার ভারতের ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক।
ভেলুর ফোর্টের ইতিহাসে রয়েছে বহু শাসকের পদচিহ্ন।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য — ফোর্টের প্রথম নির্মাতা ও মালিক।
মরাঠা শাসন — ১৭ শতকে ফোর্টটি মরাঠাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
মুঘল ও আর্কট নবাবরা — পরবর্তী সময়ে মুঘল বাহিনী ও আর্কট নবাবদের হাতে ফোর্টের দখল যায়।


ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি — ১৭৬০ সালে তারা ফোর্ট দখল করে নেয় এবং এটিকে দক্ষিণ ভারতের সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।১৭৯৯ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে মাইসোরকে স্বাধীন করতে টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে টিপু সুলতান শহীদ হলে তার অনেক পরিবারবর্গের সদস্যকে এই ফোর্টে এনে বন্দী করে রাখে ব্রিটিশরা।



১৮০৬ সালে এখানে সংঘটিত হয় ভেলুর বিদ্রোহ, যা অনেক ইতিহাসবিদের মতে ভারতের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী সিপাহী বিদ্রোহ। কারণ ছিল ধর্মীয় অবমাননা ও সেনাদের পোশাকবিধি পরিবর্তন নিয়ে অসন্তোষ। এই বিদ্রোহে শত শত ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়, যদিও পরে ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমন করে এবং অংশগ্রহণকারী অনেক ভারতীয় সৈন্যকে শাস্তি দেয়।
এই ঘটনার প্রায় ৫০ বছর পর ঘটে ১৮৫৭ সালের বৃহত্তর সিপাহী বিদ্রোহ, যা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা বলে গণ্য হয়।
বর্তমানে ভেলুর ফোর্ট ভারতের আর্কিওলজিকাল সার্ভে (ASI)-এর অধীনে সংরক্ষিত। ফোর্টের ভেতরে একটি মিউজিয়াম রয়েছে, যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে —
প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র, মুদ্রা ও পাণ্ডুলিপি
শাসকদের ব্যবহৃত অলঙ্কার ও পোশাক
দুর্গের চারপাশে রয়েছে মনোরম বাগান, হাঁটার পথ এবং দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য খোলা জায়গা।
 

ফোর্ট খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত।
প্রবেশ বিনামূল্যে (মিউজিয়ামের জন্য আলাদা টিকিট প্রয়োজন)।
সহজ উপায়ে যেতে হলে, ভেলুর শহরের যেখানেই থাকুন না কেন — অটো, বাস বা হাঁটা পথে পুরাতন বাস টার্মিনালের দিকে আসুন। টার্মিনালের ঠিক বিপরীতে রয়েছে ভেলুর ফোর্ট।
 
ভেলুর ফোর্ট কেবল একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নয়, এটি দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। যেখানে একই প্রাচীরের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে তিন ধর্মের উপাসনালয় — আর চার শতাব্দীর পুরনো এক বিদ্রোহের প্রতিধ্বনি আজও যেন দেয়ালের ভেতর ঘুরে বেড়ায়।
পুরো ফোর্ট ঘুরে দেখতে হাতে সময় নিয়ে যাওয়া উচিৎ। ফোর্টে প্রবেশ করে চাইলে প্রথমেই চারপাশ ঘুরে নিতে পারেন। খালের পাশ ধরে সুউচ্চ দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপনা — তার ওপর বা পাশ দিয়ে তৈরি পথ ধরে হাঁটতে পারবেন।
 
পুরো ভেলুর শহর পাহাড়ে ঘেরা, তাই বাইরের আক্রমণ করা ছিল কঠিন। তার ওপর ফোর্টের এই শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল এক অতুলনীয় রক্ষাকবচ।
পুরো চেন্নাই অঞ্চলে যেমন প্রচুর নিম ও তেঁতুল গাছ, ঠিক তেমনি ফোর্টের চারপাশের পথেও রয়েছে নিমগাছে ছাওয়া সবুজ ছায়া। এছাড়াও পুরো ফোর্টে অসংখ্য বৃক্ষের সমারোহ। শতবর্ষী বিভিন্ন গাছ দিয়ে পুরো ফোর্ট ঘেরা।শহরের বাইরের পাহাড়, ফোর্টের খাল আর সবুজের সমারোহে এই পথ যেন স্বর্গের পথে রূপ নেয়।
ধীরে পায়ে হেঁটে পুরো ফোর্ট দেখা উচিৎ। ফোর্টের চারপাশ ঘুরে বিশ্রাম নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মন্দির, চার্চ, মসজিদ ও রাজবাড়ি দেখতে পারেন। বর্তমানে রাজবাড়িটি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশেই দুটি জাদুঘর আছে, যেখানে সপ্তম শতাব্দীর পূর্বের মূর্তি রয়েছে। এই জাদুঘরগুলোতে প্রবেশমূল্য নেই।
 
 
শেষে মূল জাদুঘর দেখে বের হতে পারেন। মূল জাদুঘরে ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য ১০ রুপি, আর বিদেশিদের জন্য ২০০ রুপি। জাদুঘর থেকে বের হয়ে বাস টার্মিনালের সামনে ‘অলংকার’ নামে একটি বিখ্যাত হোটেল আছে — দুপুর বা রাতের খাবারে সেখানে স্থানীয় স্বাদের খাবার উপভোগ করতে পারেন।
বিঃদ্রঃ ঘুরতে গিয়ে কোথাও ময়লা ফেলবেন না এবং স্থানীয়দের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করুন।
সেপ্টেম্বর ২০২৫
															