নরসিংদী জেলার দর্শনীয় স্থান

Rafa Noman

গ্রামের পথ দিয়ে গাড়ি চলছে, ঠান্ডা বাতাস এসে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, দুইপাশে আধপাকা ধানখেত। সন্ধ্যায় বড় একটা চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের আলোয় ধানখেত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু-একদিনের ভেতর হয়তো পূর্ণিমা। ধানখেতের উপরে জোছনা ঠিকরে পড়ছে। বাতাসে সোনালি ধানের নড়াচড়া দেখেই কেমন জানি উদাস লাগছে। আকাশের সবথেকে দূরের যে তারাটি ঝলমল করছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোই লাগছে। আচ্ছা, মানুষ মরে গেলে আসলেই কি তারা হয়?

ছোটবেলায় তারা দেখে দাদা-দাদি, নানা-নানির কথা মনে করতাম। এখন এমন আকাশভরা তারা দেখলে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এখন দাদা-দাদি খুঁজি না, এখন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজতে ইচ্ছে করে। আমাদের বন্ধু হারিয়ে যাচ্ছে! কথা বলার অভাবে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। এমনি তারাভরা এক রাতে নরসিংদী যাচ্ছি। নরসিংদীকে নিজের আরেকটা বাড়ির মতো বলা যায়। এত এত আপন মানুষ, কতবার যে গিয়েছি! পুরো নরসিংদী ঘুরতে হলে দুইদিন সময় নিয়ে আসা উচিৎ।

ঢাকা থেকে ট্রেনে কিংবা  সায়দাবাদ-মহাখালী থেকে বাসে আসতে পারেন। যে কোনো সময় আসতে পারেন।ঢাকা শহরের একদম কাছেই নরসিংদী, তাই যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই ভালো। নরসিংদীর মাধবদী থেকে ঘুরাঘুরি শুরু করলে সবচেয়ে ভালো হয়, সবগুলো জায়গা ঘুরে দেখতে পারবেন ক্রমান্বয়ে। গুলিস্তান থেকে সরাসরি মাধবদীর বাস আসে, কিংবা টঙ্গী হয়ে এলে পাঁচদোনা নেমে মাধবদী যাবেন। আবার ট্রেনে এলে স্টেশন নেমে বেলানগর হয়ে মাধবদী যাবেন। ভোরে ঢাকা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে রওনা দিয়ে নরসিংদী পৌঁছে ঘুরাঘুরি শুরু করতে পারেন।

মাধবদী বাজারেই গরুহাটা নামক সিএনজি স্টেশন আছে। সেখান থেকে রিকশা, অটো কিংবা সিএনজি দিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য বালাপুর জমিদার বাড়ি।ইতিহাসের তথ্যমতে, জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা ছিলেন ঐতিহ্যবাহী বালাপুর জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং অঞ্চলের প্রধান জমিদার। সে সময় প্রায় ৩২০ বিঘা জমির ওপর অত্র অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং বিশাল আকারের এই বিলাসবহুল জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করেন তিনি। জমিদার নবীন চন্দ্র সাহার তিন পুত্র ছিলেন—কালীমোহন সাহা, আশুতোষ সাহা ও মনোরঞ্জন সাহা। বাবা জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা মারা যাওয়ার পর বড় পুত্র কালীমোহন সাহা জমিদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বালাপুর জমিদার বাড়ি

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর জমিদার কালীমোহন সাহা সপরিবারে ভারতে চলে যান। যাওয়ার আগে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান কর্মীদের কাছে। ফিরে আসার কথা থাকলেও আর দেশের মাটিতে পা রাখেননি কালীমোহন। এই বিলাসবহুল, নান্দনিক কারুকার্যসমৃদ্ধ জমিদারবাড়ির ভবনটিতে ছিল ১০৩টি ছোট-বড় কক্ষ। যার প্রতিটি কক্ষেই ছিল মোজাইক করা। ঘরের সব দরজা-জানালাগুলোতে ফুল, লতা-পাতাসহ বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর কারুকার্য মণ্ডিত ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব কারুকার্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।এ ছাড়াও ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বালাপুর নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দৃষ্টিনন্দন বালাপুর জমিদারবাড়ি ইতোমধ্যে সংস্কারের অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে।

আমাদের পরের গন্তব্য ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি। বালাপুর থেকে আবার মাধবদী এসে সেখান থেকে পাঁচদোনা বাজারে আসবেন। পাঁচদোনা বাজারেই অবস্থিত গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি

১৮৩৪ সালে নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে গিরিশ চন্দ্র সেন জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাধারে সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মের অনেক গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা ও অনুবাদ করেছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও গিরিশ চন্দ্র সেনই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি কোরআন শরীফের পবিত্রতা রক্ষা করে বঙ্গানুবাদ করার সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক হিসেবে তাঁকে “ভাই” খেতাবে ভূষিত করা হয়। পরবর্তীতে আরবি, ফার্সি ভাষার ব্যুৎপত্তি অর্জন ও কোরআন-হাদিসের প্রথম অনুবাদক হিসেবে তাঁকে “মৌলভি” উপাধি দেওয়া হয়। ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট গিরিশ চন্দ্র সেন মৃত্যুবরণ করেন।

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ি

পাশেই ড্রিম হলিডে পার্ক। চাইলে একদিনেই এই দুই জায়গা দেখে ড্রিম হলিডে পার্ক ঘুরে পাঁচদোনা থেকেই ঢাকার বাস ধরে ফিরতে পারেন। আর ড্রিম হলিডে পার্ক বাদ দিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখতে চাইলে আমার সাথে বের হয়ে যেতে পারেন।

পাঁচদোনা বাজার থেকে আমাদের পরের গন্তব্য ডাঙ্গা বাজার, পলাশ উপজেলায় এই বাজার। সি এন জি যায় পাঁচদোনা থেকে। ডাঙ্গা বাজার থেকে রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারেন লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি বা ডাঙ্গা জমিদার বাড়ি।

লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি

বর্তমানে উকিল বাড়ি হিসাবে পরিচিত এই জমিদার বাড়ি। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, এটা ছিল জমিদার লক্ষ্মণ সাহার বাড়ি। এই অঞ্চলের প্রধান জমিদার ছিলেন না। মূলত তিনি ছিলেন প্রধান জমিদারের অধীনস্থ সাব-জমিদার। জমিদার লক্ষ্মণ সাহার ছিল তিন ছেলে—নিকুঞ্জ সাহা, পেরিমোহন সাহা ও বঙ্কু সাহা। বঙ্কু সাহা দেশ ভাগের সময় এখান থেকে ভারতে চলে যান, থেকে যায় দুই ভাই।

পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার কিছু পূর্বে নিকুঞ্জ সাহাও ভারতে চলে যান। তখন থেকে যায় পেরিমোহন সাহা। এই পেরিমোহন সাহার ছিল এক ছেলে। তার নাম ছিল বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা। বৌদ্ধ নারায়ণ সাহার কাছ থেকে বাড়িটি ক্রয় করেন আহম্মদ আলী (উকিল)। মূলত আহম্মদ আলী সাহেব উকালতি পেশার সাথে সংযুক্ত ছিলেন বিধায় বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি উকিলের বাড়ি হিসেবেই বেশি পরিচিত।

লক্ষ্মণ সাহার জমিদার বাড়ি

বর্তমানে বাড়িটি প্রায় ভগ্নদশা। গাছপালা দিয়ে সবুজে শান্ত-শীতল হয়ে আছে। সান বাঁধানো ঘাট। পাশে সবুজ ধানখেতে ভরপুর এক মনোরম পরিবেশে এই উকিল বাড়ি দেখতে পাবেন। এই বাড়ির পাশেই আরেকটা জমিদার বাড়ি আছে, কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। চাইলে সেটাও ঘুরে আসতে পারেন। ডাঙ্গা জমিদার বাড়ি থেকে আবার পাঁচদোনা ফিরে আমাদের পরের গন্তব্য ঘোড়াশাল মনু মিয়ার বাড়ি। পাঁচদোনা মোড় থেকে সি এন জি বা বাসে ঘোড়াশাল নেমে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

মূলত কাগজকলমে “ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ি” হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলেও স্থানীয়দের কাছে “মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি” নামেই পরিচিত।

এটি ১১৭৬ বঙ্গাব্দে তৈরি করা হয়। জমিদার বাড়িটি “মনু মিয়ার জমিদার বাড়ি” হিসেবে পরিচিত হলেও এটির প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু জমিদার মনু মিয়া নন। এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার মনু মিয়ার পিতা “আবু ইউসুফ লুৎফুল কবির।” আবার আরেকটি মতে এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা “গোলাম নবী।” এনার ডাকনাম ছিল ফেনু মিয়া।

মনু মিয়ার বাড়ি

এখানে মনু মিয়ার বাড়ির পাশাপাশি আরও দুইজনের বাড়ি রয়েছে। তারা হলেন নাজমুল হাসান ও মৌলভি আব্দুল কবির। তারাও এই জমিদার বংশধর। তবে জমিদার মনু মিয়ার পরিচিতি পাওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে তিনি এলাকার একজন পরিচিত মুখ ছিলেন। তার পুরো নাম আহমুদুল কবির মনু মিয়া। তাই তার নামেই এখন এই জমিদার বাড়ির নাম মানুষের মুখে মুখে। কারণ তিনি এই জমিদার বংশের মধ্যে একজন সফলতম ব্যক্তি ছিলেন। শুধু তিনি নয়, তার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে সকলেই তাদের কর্মদক্ষতার ফলে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত।

মনু মিয়ার বাড়ি

বর্তমানে এটি একটি প্রাইভেট প্রপার্টি হিসেবে আছে, তাই বেশি মানুষ চাইলে যেতে পারে না। হাতে দুই দিন সময় নিয়ে আসলে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সোনাইমুড়ি টেক ঘুরে আসতে পারেন। পাশেই একটি গ্যাসকূপ আছে।

নরসিংদী থেকে শিবপুর যাওয়ার পথে চোখে পড়বে গাছপালায় ঘেরা লাল মাটির অসংখ্য টিলা। এসব টিলার চূড়া থেকে  ছোট ছোট পাহাড়ের মত টিলা ও সমতলের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। লাল মাটির এই টিলার মাঝ দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। জায়গাটি শুটিং স্পট হিসেবেও জনপ্রিয়, যেখানে প্রায়ই নাটক ও সিনেমার দৃশ্য ধারণ করা হয়। শিশুদের জন্য সোনাইমুড়ি টেকে রয়েছে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা।

সরিষা ফুলের মৌসুমে

নরসিংদী সব ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখতে চাইলে একদিনে সম্ভব নয়। নরসিংদী শহরে থাকতে চাইলে রেলওয়ে স্টেশনের আশেপাশে বেশ কয়েকটি থাকার হোটেল আছে, কিংবা সরকারি সার্কিট হাউস ও ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন। শহরে আশেপাশে ঘুরতে পারেন—মেঘনার আশপাশে, নাগরিয়াকন্দি ব্রিজের কাছে, আড্ডা, সূর্যমুখি বাগান, সরিষা ফুলের মৌসুমে বিস্তীর্ণ সরিষা ফুলের সমারোহ ও পার্ক ঘুরে আসতে পারেন।

মেঘনার চর

আমাদের পরের গন্তব্য ঐতিহাসিক উয়ারী-বটেশ্বর।

পাঁচদোনা থেকে কিংবা নরসিংদী যে কোন জায়গা থেকে প্রথমে মরজাল বাজারে আসতে হবে। বাজার থেকে অটো, রিকশা, সি এন জি যেকোনো মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বর যেতে পারেন। মূলত দুটি গ্রাম নিয়ে গঠিত।

বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে উয়ারী-বটেশ্বর একটি বিশেষ নাম। বাংলাদেশের প্রাচীনতম মহাজনপদের আবিষ্কার এবং গবেষণার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান এবং তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠান। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে মহানগর ছিল।

১৯৩০ সালে উয়ারী গ্রামে কিছু শ্রমিক মাটি খননের সময় একটি পাত্রভর্তি প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রা উদ্ধার করে। অধিকাংশ মুদ্রা হাতবদল হয়ে গেলেও হানিফ পাঠান দ্রুত ৩০–৩৫টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি নিশ্চিত হন যে এলাকায় নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের উদ্যোগে এসব নিদর্শন সংগ্রহ করতে শুরু করেন এবং একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাও গড়ে তোলেন।

১৯৫০ সালে বটেশ্বর গ্রামে খননের সময় দুটি লোহার পিণ্ড পাওয়া যায়, যেগুলোর একটি ছিল ত্রিকোণাকার এবং অপরটির একপাশ ছিল চোখা। তার এক বছর পর উয়ারী গ্রামে আবিষ্কৃত হয় তিন হাজারেরও বেশি রৌপ্যমুদ্রা সম্বলিত ভাণ্ডার। এসব আবিষ্কারের পর থেকে হানিফ পাঠান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

উয়ারী-বটেশ্বর

পরবর্তীতে তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠানও এ কাজে যুক্ত হন। ১৯৭৪–৭৫ সালের দিকে তিনি আরও কিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে জাদুঘরে জমা দিতে শুরু করেন। দীর্ঘ সময় অবহেলিত থাকার পর ২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন করে শুরু হয় খনন কাজ। এর ফলেই উন্মোচিত হয় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো দুর্গ নগরী, গলি, ইটের স্থাপনা, দুর্লভ পাথর, পাথরের তৈরি বাটখারা, কাঁচের পুঁতির মালা এবং মুদ্রাভাণ্ডার।বর্তমানে হানিফ পাঠান আর বেঁচে না থাকলেও তার শখের সংগ্রহশালাটি রয়ে গেছে।

হাবিবুল্লাহ পাঠান আজও তার পিতার রেখে যাওয়া এই ঐতিহাসিক ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।

উয়ারী-বটেশ্বরের প্রায় ৫০টি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন প্রকার হাতিয়ার—নব্যপ্রস্তর যুগের কাঠের সরঞ্জাম, পাথরের দু’ধারী কুঠার, ছুরি, হাতুড়ি-বাটালি, লৌহবল্লম ইত্যাদি।

নিদর্শন

আবিষ্কৃত গ্রানাইট, ক্রিস্টাল ও জেস্পারের বিভিন্ন মাপ ও আকারের বাটখারাগুলো সম্ভবত পুঁতি পরিমাপ করার কাজে ব্যবহৃত হতো। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে পাওয়া গেছে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের নিদর্শনও—যেমন স্যান্ডউইচ-আকৃতির কাঁচের পুঁতি এবং রোলেটেড মৃৎপাত্র। এসব প্রমাণ করে যে, এ জনপদের সঙ্গে দূর-দূরান্তের সভ্যতা ও নগরীরও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।

খননের ফলে উন্মোচিত হয় প্রাচীন দুর্গনগরীর বিভিন্ন নিদর্শন। গর্তে নির্মিত ঘর, পানি সংগ্রহের কূপ, রান্নার জন্য ব্যবহৃত বিভিন্ন চুলা, কালো ও লাল পোড়ামাটির পাত্র—এসবই প্রমাণ করে এখানে ছিল একটি সুসংগঠিত নগরজীবন।

প্রাপ্ত পাথরের খণ্ড পরীক্ষা করে ইতিহাসবিদরা ধারণা করেছেন, কিছু খণ্ড হয়তো জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতির সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হতো। অর্থাৎ এ জনপদের মানুষেরা শুধু দৈনন্দিন জীবনে দক্ষ ছিলেন না, বরং গণিত ও পরিমাপ সম্পর্কেও তাদের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।

নিদর্শন

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হলো প্রচুর পুঁতি ও পুঁতির মালা, যা প্রমাণ করে এখানে পুঁতি তৈরির কারখানা ছিল। এসব পুঁতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। পাশাপাশি পাওয়া গেছে বিভিন্ন মাপের বাটখারা, যা তাদের বাণিজ্যিক কার্যকলাপকে স্পষ্ট করে।

বর্তমানে দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ হলো চারিদিকে পরিখা-ঘেরা ৬০০x৬০০ মিটার আয়তনের চারটি দুর্গপ্রাচীর এবং অসমরাজার গড়। এছাড়া উয়ারী-বটেশ্বর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে শিবপুর উপজেলার ‘মন্দির-ভিটা’ নামের একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং নিকটবর্তী জংখারটেক গ্রামে আরেকটি বৃহৎ বৌদ্ধমন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো থেকে ধারণা করা হয় যে উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন জনপদ মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেন্দ্র ছিল।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, রাঙারটেক, সোনারতলা, কেন্ডুয়া, মরজাল, টঙ্গীরাজার বাড়ি, টঙ্গীরটেক, জংখারটেক ও মন্দির-ভিটা এলাকায় সবচেয়ে বেশি প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রতিটি স্থানই বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের অমূল্য দলিল হিসেবে বিবেচিত।

লটকন বাগান

মরজালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি লটকন উৎপাদন হয়। তাই উয়ারী-বটেশ্বর যাবার সময় লটকনের মৌসুম থাকলে অবশ্যই লটকন বাগান ঘুরে আসতে পারেন। পাশাপাশি নরসিংদীর লেবু বাগানও পাবেন। হাতে সময় থাকলে মরজাল থেকে আবার বেলাবো বাজারে এসে বেলাব বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি দেখতে পারেন। প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মসজিদের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা ছিলেন জনাব মাহমুদ ব্যাপারী। মসজিদটি যখন প্রথম নির্মিত হয়, তখনই এটি অত্র এলাকার অন্য মসজিদ থেকে ভিন্ন কাঠামোর। প্রথম নির্মাণের সময় এর সাতটি গুম্বুজ ছিল। লোকমুখে শোনা যায়, এই মসজিদের ভিতরে প্রতিষ্ঠালগ্নের দিকে অলৌকিকভাবে বা গায়েবীভাবে কুরআন তেলওয়াত শোনা যেত। ফলে এই মসজিদটি ফজিলতের মসজিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

বেলাব বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ

একই উপজেলায় হযরত শাহ ইরানির মাজার আছে। চাইলে যেতে পারেন। স্থানীয়ভাবে এটিকে সারানীর মাজার বলে। হযরত শাহজালাল (র) এর আমলে একসাথে এই অঞ্চলে আসেন ধর্ম প্রচারে। আমি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গিয়েছি এগুলোতে। বেলাব বাজার থেকে আবার মরজাল ফিরে আসতে হবে।

মরজাল বাজার থেকে আমাদের পরের যাত্রা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর। মরজাল বাজার থেকে সি এন জি বা ভৈরবগামী বাসে উঠে জগন্নাথপুর ব্রিজের আগে নেমে অটো বা রিকশায় রামনগর যেতে হবে। স্থানীয়ভাবে মতিউর নগরকে রামনগর হিসেবে চিনে।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর হলো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের পৈতৃক নিবাস, নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রাম, যা এখন মতিউরনগর নামে পরিচিত। এই স্থানে মতিউরনগর দাখিল মাদরাসা এবং বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর কলেজ অবস্থিত, ও একটি জাদুঘর করা হয়েছে। পাশেই একটি পুরোনো মসজিদ আছে, দেখে আসতে পারেন। এছাড়াও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আটকান্দি গ্রামে অবস্থিত আটকান্দি নীলকুঠি জামে মসজিদ আছে এটি মাওলানা আলীম উদ্দিন প্রায় ২০০ বছর আগে নির্মাণ করেন এবং মেঘনা নদীর শাখা নদীর পাশে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য।  সময় থাকলে দেখে আসবেন।

মতিউর নগর

মতিউর নগর থেকে মরজাল কিংবা জগন্নাথপুর এসে বাসে ঢাকায় ফিরতে পারেন, কিংবা কাছেই ভৈরব, সেখান থেকে আপনার গন্তব্যে যেতে পারেন। আবার নরসিংদী ফিরে যে কোনো জায়গায় যেতে পারেন।

সিলেট কিংবা ময়মনসিংহ থেকে আসতে চাইলে ঠিক শেষ থেকে শুরু করে বালাপুর জমিদার বাড়ি গিয়ে শেষ করতে পারেন।

আমরা নরসিংদী ফিরে নরসিংদী সরকারি কলেজে আড্ডা দিয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে রাতের মেঘমুক্ত আকাশ দেখতে দেখতে ঢাকা ফিরছি। আকাশ দেখেই উদাস হয়ে গেছে মনটা আমরা দিন দিন বন্ধু হারিয়ে ফেলছি একা হয়ে যাচ্ছি কি ভয়ংকর কথা!

বিঃদ্রঃ ঘুরতে গিয়ে কোথাও ময়লা ফেলবেন না এবং স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।

জুলাই-২০২৩

 

{{ reviewsTotal }}{{ options.labels.singularReviewCountLabel }}
{{ reviewsTotal }}{{ options.labels.pluralReviewCountLabel }}
{{ options.labels.newReviewButton }}
{{ userData.canReview.message }}

Hi, I'm Rafa

Welcome to my world of exploration! I’m a passionate travel blogger from Bangladesh, dedicated to showcasing the incredible beauty and rich culture of my homeland.

Find us on Facebook