ঢাকানাম-১
															ঢাকাকে কেন জাদুর শহর বলে জানি না। জানতে ইচ্ছেও করে না। এক যুগের বেশি হয়ে গেছে ঢাকায় থাকি। তবে এইটুকু জানি বাড়ি থাকতে সারাদিন বের না হলে সন্ধ্যায় পাগল হবার উপক্রম হতো। আর ঢাকায় এক রুমে টানা দুই দিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলেও খারাপ লাগে না। এই যে জ্যামের জন্য কত শত ঘন্টা হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে তবু জ্যামটাকে’ই মিস করি ঢাকা ছেড়ে দিলে। কিসের টানে মানুষ ঢাকা থেকে দফ্যবগ৷ যায় জানি না। একবার ঢাকা ডুকে গেলে আর বের হওয়া যায় না কেন জানি না। জানতেও চাই না। ঢাকার অনেক ডার্ক সাইট থাকলেও আমার কাছে ঢাকা জাদুর শহর। প্রতিনিয়ত ঢাকা আমাকর টানে।
ঢাকায় ঘুরাঘুরির মত ঐতিহাসিক ও চিত্তাকর্ষক অনেক জায়গা আছে যেগুলো তে কিভাবে যাবো বলতে পারেন কোনটার পর কোনটায় গেলে সুবিধা হয়,এই হারিয়ে যাবার মত শহরে সেই নিয়ে আজকের লেখা।
রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স ৪০০ বছর বলেই সবাই জানে। মোঘল সুবাদার ইসলাম খান ১৬১০ সালে নগর ঢাকার পত্তন করেন। এমনটাই ইতিহাস বলে। কিন্তু বদলে যাচ্ছে সেই ইতিহাস। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া নিদর্শন ও প্রাচীন দুর্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করছে। ১৪৩০ সালেই এখানে বিশাল প্রাসাদ দূর্গ নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ সমৃদ্ধ রাজধানী শহর ছিল এখানে।
শুধু তা-ই নয়, খননে এমন কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। যা থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা অনুমান করছেন। ঢাকা নগরীতে মানব বসতির শুরু যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকের মধ্যে। ফলে এই জনপদের বয়স আড়াই হাজার বছরের বেশি।
ঢাকার নামকরণের সঠিক ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কথিত আছে যে, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভ্রমণকালে সন্নিহিত জঙ্গলে হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিগ্রহ খুঁজে পান। দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ রাজা বল্লাল সেন ঐ এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যেহেতু দেবীর বিগ্রহ ঢাকা বা গুপ্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। তাই রাজা, মন্দিরের নাম রাখেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের নাম থেকেই কালক্রমে স্থানটির নাম ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠে।
আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন সুবাদার ইসলাম খান আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ শহরে “ঢাক” বাজানোর নির্দেশ দেন। এই ঢাক বাজানোর কাহিনী লোকমুখে কিংবদন্তির রূপ নেয় এবং তা থেকেই শহরের নাম ঢাকা হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, মোঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু সময় ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিলো।
ঢাকা নগরীকে বর্তমানে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়েছে – ঢাকা দক্ষিণ ও ঢাকা উত্তর। ঢাকা দক্ষিণই মূলতঃ মূল পুরতান নগরী। ঢাকা উত্তর ঢাকার নবীন বর্ধিত উপশহরগুলো নিয়ে গঠিত। দেশের সব জেলা থেকে বাস,ট্রেন কিংবা লঞ্চ বা প্লেনেও আসা যায় ঢাকা শহরে। এয়ারপোর্ট ছাড়া বেশির ভাগ বাস টার্মিনাল রেলওয়ে স্টেশন ও লঞ্চ ঘাট সবই গুলিস্থানের আশেপাশে। এখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু করতে পারি কিংবা যেখানেই থাকুন লোকাল বাস বা মেট্রো তে ঘুরতে পারেন রাজধানী শহর। রাতে থাকার জন্য সব এলাকাতেই হোটেল আছে দেখে শুনে উঠে গেলে কিংবা পরিচিত আত্মীয় স্বজনের বাসায় থেকে ঢাকা ঘুরতে পারেন।
গুলিস্থান থেকে আমাদের প্রথম যাত্রা শুরু জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররম দিয়ে । জিরো পয়েন্ট কাছেই বায়তুল মুকাররম বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ গৃহীত হয়।
আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকাতে বিপুল ধারণ ক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল নিকটবর্তী।
বিশিষ্ট স্থপতি টি. আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই মসজিদে একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। ৬০ এর দশকের আগে এখানে একটা পুকুর ছিল পল্টন এলাকার নাম অনুসারে পল্টন পুকুর ছিল সেটা ভরাট করেই এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আধুনিক স্থাপত্যে কম অলংকরণই একটি বৈশিষ্ট্য-যা এই মসজিদে লক্ষনীয়। এর অবয়ব অনেকটা পবিত্র কাবা শরিফের মতো হওয়ায় মুসলমানদের হৃদয়ে এই মসজিদটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে।
মসজিদের পাশেই বাংলাদেশের জাতীয় স্টেডিয়াম।বাইতুল মোকাররম এর সামনে থেকে আমাদের পরের যাত্রা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। গুলিস্থান থেকে লেগুনা বা রিকসায় যেতে পারেন মন্দিরের সামনে।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সাথে দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা রিকশার শহর বলা চলে। আমার কাছে রিকশা সবসময় জুইতের মাথা উচু করে আকাশ দেখ যায়। মন্দির থেকে আমাদের পরের গন্তব্য লালবাগ কেল্লা যদিও হাঁটা পথ তবু পুরান ঢাকার অলগলি বলে কথা রিকশা যুগে গেলেই ভালো। মন্দিরের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে লালবাগ কেল্লায় নেমে টিকিট কেটে ঢুকে যেতে পারেন।
লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে। তৎকালীন মুঘল সম্রাট আজম শাহ এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। যদিও আজম শাহ খুব কম সময়ের জন্যেই মুঘল সম্রাট হিসেবে ছিলেন। তবুও তার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার এই অসাধারণ কাজটি শুরু করেন। উল্লেখ্য আজম শাহ ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর পুত্র আর সম্রাট শাহ জাহানের নাতি। যিনি তাজমহল তৈরির জন্যে বিশ্ব মহলে ব্যাপক সমাদৃত। এই দূর্গ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় তার বাবার ডাকে তাকে দিল্লিতে চলে যেতে হয় সেখানকার মারাঠা বিদ্রোহ দমন করবার জন্যে। সম্রাট আজম শাহ চলে যাওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই দূর্গ নির্মাণের কাজ আদৌ সম্পূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন নবাব শায়েস্তা খাঁ পুনরায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন কাজ থেমে যাওয়ার প্রায় এক বছর পরে। পুরো উদ্যোমে আবার কাজ চলতে থাকে দূর্গ নির্মাণের। তবে শায়েস্তা খাঁ পুনরায় কাজ শুরু করার প্রায় চার বছরের মাথায় দূর্গের নির্মাণ কাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দূর্গটি নির্মাণের কাজ আর শুরু করা হয়নি। নবাব শায়েস্তা খাঁ এর মেয়ে পরী বিবি মারা যাওয়ার কারণেই মূলত শায়েস্তা খাঁ লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। পরী বিবির মৃত্যুর পরে সবার মধ্যে দূর্গটি সম্পর্কে বিরুপ ধারণা জন্ম নেয়। সবাই দূর্গটিকে অপয়া ভাবতে শুরু করে দেয়।পরী বিবির মৃত্যুর পর তাকে লালবাগ দূর্গের মাঝেই সমাহিত করা হয়। আর এরপর থেকে একে পরী বিবির সমাধি নামে আখ্যায়িত করা হয়। পরী বিবির সমাধির যে গম্বুজটি আছে তা একসময় স্বর্ণ খচিত ছিল। কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই। তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেল্লাতে একটি মসজিদ আছে। আজম শাহ দিল্লি চলে যাওয়ার আগেই তিনি এই মসজিদটি তৈরি করে গিয়েছিলেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি যে কারো দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। মসজিদটিতে জামায়াতে নামায আদায় করা হয়। ঢাকায় এতো পুরনো মসজিদ খুব কমই আছে লালবাগ কেল্লায় সর্বসাধারণের দেখার জন্যে একটি জাদুঘর রয়েছে। যা পূর্বে নবাব শায়েস্তা খাঁ এর বাসভবন ছিল আর এখান থেকেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। শায়েস্তা খাঁ এর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সে সময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদিও রয়েছে।
কেল্লা থেকে বের হয়ে আমাদের পরের যাত্রা বড় কাটরা এখানেও রিকশা দিয়েই যাওয়া উত্তম। বড় কাটরা ঢাকায় চকবাজারের দক্ষিণে অবস্থিত মুঘল আমলের একটি সরাইখানা। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে দিওয়ান (প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা) মীর আবুল কাসিম দ্বারা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। তিনি মীর-ই-ইমারত নামে পরিচিত ছিলেন। প্রথমে এতে শাহ সুজার বসবাস করার কথা থাকলেও পরে এটি মুসাফিরখানা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে এটি জামিয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম, বড় কাটরা মাদ্রাসার তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
বড় কাটরা থেকে বের হয়ে আরো এক ইতিহাসের সামনে যাওয়া যায়। যার নাম আর্মেনিয়ান চার্চ। হাঁটা পথ মিনেট পনের তবু রিকশা দিয়ে যেতে পারেন।
https://rafanoman.blogspot.com/2023/08/blog-post.html
এই ব্লগে চার্চ নিয়ে বিস্তারিত আছে।
পুরান ঢাকা মানেই যেন অলিগলি গা ঘেঁষে চলা মানুষ। মসজিদের মিনার, বিরিয়ানি আর ইতিহাসের গন্ধ মেশানো বাতাস। কিন্তু এই শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে এমন এক স্থাপনা। যেটার সামনে দাঁড়ালে সময় থেমে যায়। আর্মেনিয়ান চার্চ অব দ্য হলি রেসারেকশন। আরমানিটোলায় অবস্থিত—ঢাকার এক বিস্মৃত ইতিহাসের নীরব প্রহরী।
লোহার ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই মনে হবে। যেন অন্য কোনো শতাব্দীতে ঢুকে পড়েছি। দেয়ালে খসে পড়া রঙ, মেঝেতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো আর বাতাসে ছড়িয়ে থাকা ধুলোর গন্ধ—সব কিছুতেই এক রকম বিষণ্ণ নান্দনিকতা। এই চার্চ তৈরি হয়েছিল ১৭৮১ সালে আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান বণিকদের হাতে। তারা এসেছিল পারস্য ও আর্মেনিয়া অঞ্চল থেকে, রেশম, চামড়া, ওষুধ আর মসলা নিয়ে ব্যবসা করতে। তারা শুধু ব্যবসা করেনি। ঢাকায় গড়েছিল বসতি, পরিবার, জীবন। আর তাদের বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল এই চার্চ—তাদের উপাসনা আর পরিচয়ের কেন্দ্র।
চার্চের ভেতরে হেঁটে যাওয়ার সময় কবরগুলো পাশে দাঁড়ালাম। পাথরে খোদাই করা নাম, তারিখ আর আর্মেনিয়ান ভাষায় কিছু শব্দ। এখানে শুয়ে আছেন তারা—যারা একসময় ঢাকাকে নিজের শহর ভাবতেন। বিশেষ করে ক্যাথরিন নামের এক নারী ব্যবসায়ী। যিনি এই শহরে দানশীলতা ও মানবসেবার জন্য পরিচিত ছিলেন।
আমি যখন বের হচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন পেছন থেকে কেউ ডেকে বলছে—”আমরা একসময় এখানে ছিলাম আমাদের মনে রেখো”।
আরমানিটোলা থেকে বের হয়ে মিনেট দশেকের পথ ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল। তার আগে আরমানিটোলায় ১৮ শতকে নির্মিত তারা মসজিদ দেখে আসতে পারেন,তৎকালীন ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর মসজিদটি নির্মান করেন।
আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারীর সদর কাচারি। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তখনকার নবাবদের ব্যবহৃত অনেক তৈজসপত্র আছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ-র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। আহসান মঞ্জিল কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। এখন এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি জাদুঘর।
টিকেট কেটে ঢুকতে হয় আহসান মঞ্জিলে। আহসান মঞ্জিল সদরঘাটেই। সদরঘাট ঘুরার আর্দশ সময় সন্ধ্যা। দক্ষিণের সব লঞ্চ তখনি ছাড়ে। ঢাকার সবথেকে বড় ফলের আড়ৎ ও সদরঘাটেই। সদরঘাট থেকে বের হয়ে বিউটি বোর্ডিং যেতে পারেন। হাঁটা বা রিকশা পথে ।
বিউটি বোর্ডিং হল পুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি হোটেল এবং রেস্তোরাঁ । এটি বাঙালি লেখক, কবি, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং রাজনীতিবিদদের বৌদ্ধিক সমাবেশের একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্র। এই স্থানটি তাদের শিল্প ও লেখায় ব্যাপকভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। বর্তমানে, এই স্থানটি বাঙালি খাবার পরিবেশনের জন্য জনপ্রিয়। যদিও এটি অন্যান্য ভারতীয় খাবারও পরিবেশন করে।
ভবনটি মূলত একটি জমিদার বাড়ি ছিল এবং শুধীর দাস নামে একজন জমিদারের ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে ভবনটি দৈনিক সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল । ১৯৫১ সালের মধ্যে, সংবাদপত্রটি কলকাতায় তার অফিস স্থানান্তরিত করে। সংবাদপত্রটি চলে যাওয়ার পর, স্থানীয় প্রতিবেশী নলিনী মোহন সাহা ভবনটি ভাড়া নেন এবং তিনি সেখানে একটি রেস্তোরাঁ এবং বোর্ডিং হাউস শুরু করেন।
বোর্ডিং হাউসটির নামকরণ করা হয় নলিনী মোহন সাহার বড় মেয়ে বিউটির নামে। শীঘ্রই বিউটি বোর্ডিং সারা দেশের বই ব্যবসায়ীদের কাছে একটি জনপ্রিয় জায়গা হয়ে ওঠে। যারা ঢাকার বই প্রকাশনা মুদ্রণ এবং স্টেশনারি পাইকারি বাজার বাংলাবাজারে আসতেন। সবাই উঠতেন এবং খেতেন এখানে।
চাইলে বিউটি বোডিং এ খেয়ে আসতে পারেন। কিংবা পুরো পুরান ঢাকা জুড়ে বিভিন্ন বিখ্যাত খাবার দোকান আছে। পুরান ঢাকার নাম শুনলেই বাহারি খাবারের কথা মনে হয়। যেমন কাচ্চি,বিরিয়ানি, কাবাব বিউটি লাচ্ছি সহো অসংখ্য খাবারে ভরপুর পুরান ঢাকা। বিউটি বোডিং থেকে বের হয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে যেতে পারেন হাতে সময় থাকলে একপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় তার পাশেই পার্কটি। সময় থাকলে জগন্নাথ ও পার্ক দুই জাগায় ঘুরতে পারেন।
বাহাদুর শাহ পার্ক পূর্বে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত। বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নগর উদ্যান । ১৯ শতকে নির্মিত, এটি ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিদ্রোহের সময় নিহত সৈন্যদের স্মরণে নির্মিত । শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের নামে নামকরণ করা এই উদ্যানটিতে বেশ কয়েকটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে এবং এটি একটি ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক এবং স্থানীয়দের জন্য একটি জনপ্রিয় বিনোদন মূলক স্থান হিসেবে কাজ করে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে, আর্মেনীয়রা বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের স্থানে ঢাকার প্রথম ইউরোপীয় ধাঁচের ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। যার আনুষ্ঠানিক নাম আর্মেনিয়ান ক্লাব। তারা বিলিয়ার্ডের মতো বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করত। যার ফলে ক্লাবটি ‘আন্তাঘর’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের কাছে সংলগ্ন মাঠটিকে ‘আন্তাঘর ময়দান’ বলা হত। আন্তাঘর একটি বিনোদন কেন্দ্র এবং ঢাকায় ইউরোপীয়দের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিলনস্থল হিসেবে কাজ করত। যেখানে রবিবারে ১৫০ জন পর্যন্ত লোক সমাগম হত, অন্যদিকে স্থানীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে থেকে বাস বা যে কোন বাহনে করে শাহবাগ আসতে পারবেন। আমাদের পরের গন্তব্য জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরটি যেহেতু ৫ টা পর্যন্ত প্রবেশ করা যায় তাই তার আগেই যেতে হবে।
১৯১৩ সালের ০৭ আগস্ট বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) একটি কক্ষে ৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট জাদুঘরটি দর্শকদের জন্য খুলে দেয়া হয়। ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা জাদুঘর ঢাকার নায়েব-নাজিম-এর নিমতলীস্থ প্রাসাদের বারদুয়ারী ও দেউরীতে স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অধ্যাদেশ ১৯৮৩ জারি করে ঢাকা যাদুঘরের সব সম্পদ, নিদর্শন, দায়-দায়িত্বসহ সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাথে আত্তীকৃত করা হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৮৩ বর্তমান ভবনে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের যাত্রা শুরু হয়।
প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য তথা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপাদান, প্রত্ননিদর্শন এবং মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রহ জাদুঘরের মূল আকর্ষণ। ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি যেমন- প্রস্তর ও ধাতব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় মুদ্রা, শিলালিপি, তুলট কাগজ ও তালপাতায় লেখা সংস্কৃত, বাংলা ও আরবি-ফার্সি পাণ্ডুলিপি, মধ্যযুগীয় অস্ত্রশস্ত্র, বাংলাদেশের দারু ও কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, সমকালীন ও বিশ্বসভ্যতার চিত্রকলা ও ভাস্কর্য, বাংলাদেশের গাছপালা, পশুপাখি, শিলা ও খনিজ ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শনাদি জাদুঘরের মূল সংগ্রহ। জাদুঘরে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, তিনটি মিলনায়তন ও দুটি প্রদর্শনী গ্যালারি রয়েছে।
জাদুঘরের থেকে হাঁটা পথে রমনা পার্ক যেতে পারেন সবুজে ছায়াঘেরা রমনা শতবর্ষী বিভিন্ন গাছ লেক স্নিগ্ধ বিকাল কাটানোর জন্য সেরা। ঢাকার ফুসফুস বলা হয় রমনা’কে। পহেলা বৈশাখে এখানেই অনুষ্টান হয়। রমনা পার্ক থেকে রাস্তা পার হলে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি সুপরিসর নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেসকোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসাবে ডাকা হত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনও কখনও ঢাকা রেসকোর্স নামে ডাকা হত এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। এটি জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ এখানেই প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্রবাহিনীর কাছে। রেসকোর্স ময়দানের অ-দূরে অবস্থিত তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের স্থান হিসেবে প্রথমে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আত্মসমর্পনের জন্য এই মাঠটি নির্বাচন করা হয়।
রেসকোর্সের আশেপাশে পুরানো হাইকোর্ট ভবন রমনা কালী মন্দির। জাতীয় তিন নেতা শেরে-বাংলা এ. কে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি।
স্বাধীনতা জাদুঘর ,পশ্চিমে বাংলা একাডেমী। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ঢাবি, চারুকলা ইনস্টিটিউট ঢাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, পাবলিক লাইব্রেরি এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। উত্তরে বারডেম হাসপাতাল পিজি হাসপাতাল, ঢাকা ক্লাব ও ঢাকার টেনিস কমপ্লেক্স এবং পূর্বে সুপ্রীম কোর্ট ভবন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট ও রমনা পার্ক।
উদ্যান থেকে বের হয়ে দোয়েল চত্তর থেকে একটু সামনেই কার্জন হল তার একটু সামনেই মহান ভাষা আন্দোলন এর শহীদ মিনার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের পাশেই শহীদ মিনার। শহীদ মিনার থেকে বের হয়ে সন্ধ্যা কাটাতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসে পাশেই টি এস সি। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধী। রাজু ভাস্কর্য, ফুলার রোড, কলাভবন ঘুরতে পারেন।
সন্ধ্যার পর চাইলে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে নীলখেত বইয়ের দোকান কিংবা নিউমার্কেট থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এছাড়াও ঢাকার দক্ষিণ তথা পুরান ঢাকায় অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে দেখতে পারেন হাতে সময় নিয়ে। যেমন রুপলাল হাউস, নবাবগঞ্জের কোকিল পেয়ারী জমিদার বাড়ি,নবাগঞ্জের বিখ্যাত দানশীল ডাকাত সর্দার খোলারাম দাতার বাড়ি, পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোডের শঙ্খনিধি হাউস, পুরান ঢাকার কেরানীগঞ্জ জিঞ্জিরা প্রাসাদ,বুড়িগঙ্গার তীরে নর্থব্রুক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুদুয়ারা নানকশাহী। পুরান ঢাকার চানখাঁরপুলে হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া,টিকাটুলিল রোজ গার্ডেন এছাড়াও পুরান ঢাকায় অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে শুধু এই অঞ্চল ভালো করে ইতিহাসের ভেতর ঘুরে দেখতে চাইলে দুই তিন লেগে যাবে। পুরান ঢাকার ইতিহাস সংস্কৃতি নিয়ে বহু গল্প আছে।
ঢাকার এই অঞ্চলের প্রতিটা ঐতিহ্য নিয়ে আলাদা করে লিখা উচিৎ। পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করেই আজকের ঢাকার বিস্তার। কিন্তু সেই পুরান ঢাকা আর কেন্দ্রে থাকতে পারেনি। এখন এর অবস্থান প্রান্তে এবং ঢাকার মধ্যেই এক ভিন্ন ঢাকা।
পুরান ঢাকার ভিন্নতা সবকিছুতেই। এর অলিগলি, স্থাপত্য, খাবার ও খাবারের দোকান, ভাষা বা রসবোধ, গলির আড্ডা, এমনকি গন্ধ—সবই যেন নিজস্ব।
পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে হাঁটলে মনে হবে এই বুঝি কোন ভিস্তিওয়ালা পানি নিয়ে হেটে যাচ্ছে।সেখানকার ‘মহল্লাবাসী’ এর কতটা টের পায়, কে জানে! কিন্তু পুরান ঢাকার এসব প্রাত্যহিকতাই তো একজন আগন্তুক হিসেবে আমার কাছে অনন্য।
বিঃদ্রঃ ঘুরতে গিয়ে কোথাও ময়লা ফেলবেন না এবং স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
জুন ২০২৪
															

















